পার্বত্য জেলা গুলোর পাহাড়ে গড়ে উঠা বাগানে ডালে ডালে ঝুলছে নানা জাত ও রঙের বিদেশি আম। এসব আম দেখতে যেমন বিচিত্র, স্বাদও ভিন্ন। সবকটি আমের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বাহারি নাম। কোনটির নাম আমেরিকান পামলার, কোনটি রেড আইভরি, ব্যানানা ম্যাংগো কিংবা কোনটি পরিচিত আপেল ম্যাংগো নামে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দশক আগেও পার্বত্য জেলার পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হতো না। কিন্তু ২০০৪ সালের পর থেকে বদলে যেতে শুরু করে পাহাড়ি এলাকায় আম চাষের চিত্র। একে একে শুরু হয় রেড এম্পেরর বা চাকাপাত, ব্যানানা ম্যাংগো, কার্টিমন, কিউজাই, রেড লেডি, আপেল ম্যাংগো, মিয়াজাকি বা সূর্যডিম, অস্ট্রেলিয়ান কেনসিংটন প্রাইড, হানিডিউ, আরটুইটুসহ বিভিন্ন জাতের বিদেশি আমের চাষ।
আর্কষণীয় রং ও সুস্বাদু হওয়ায় চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এসব আম। প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল পেরিয়ে সারাদেশেই আম যাচ্ছে এখানকার আম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপযুক্ত মাটি ও আবহাওয়ায় কারণে বিদেশি আমের অধিক ফলন হচ্ছে এই অঞ্চলে। প্রচলিত দেশি আমের চেয়ে বাজার দর কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় বিদেশি আম চাষে ঝুঁকছেন চাষীরা। তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ৫০ হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা ফল চাষে যুক্ত হয়েছেন। দুই দশক আগেও পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হতো না। ২০০৪ সাল থেকে মূলত বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান করা শুরুর পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ফলবাগানের সংখ্যা।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৩- ২০০৪ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি তৎকালীন সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভুইয়ার উদ্যোগে নেওয়া ‘কালিকাপুর মডেল প্রকল্পের’ আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় আম্রপলির চারা বিতরণ করা হয় বিনামূল্যে। বাসিন্দারা অনাবাদি টিলাভূমিতে এ আমের চারা রোপন করে দুই বছর পরই ফল পেতে শুরু করে। ফলনও হয় অনেক বেশি। সুস্বাদু ও সুমিষ্ট হওয়ায় অল্প সময়েই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এ বিদেশি জাতের আম। ফলে পুরো পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে আম্রপালির আবাদ। পরবর্তীতে আম্রপালির সঙ্গে যুক্ত হয় মিয়ানমারের রাংগুই আম। গত ৪ থেকে ৫ বছরে পাহাড়ের মাটিতে ঠাঁই নেয় জাপানের বিশ্বখ্যাত মিয়াজাকিসহ বিভিন্ন জাতের বিদেশি আম।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জমিতে বিদেশি জাতের সফল আম চাষীদের একজন সদর উপজেলার মংশিতু চৌধুরী। ২০১৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে আম চাষ শুরু করেন তিনি। সদর উপজেলার ভূয়াছড়ি এলাকায় শুরু করেন ‘মং গ্রীণ লাইফ এগ্রোফার্ম’। বর্তমানে প্রায় ৩০ একরের তার বাগানে প্রায় ৫৪ জাতের বিদেশি আমের চাষ হচ্ছে।
মংশিতু চৌধুরী বলেন, প্রচলিত দেশি আমের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হয় বিদেশি আম। এই মৌসুমে ৫০ লাখ টাকার আম বিক্রির আশা করছি।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. বাছিরুল আলম জানান, খাগড়াছড়ি জেলায় এবার ৪ হাজার ৪২১ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে বেশি হয়েছে আমের চাষ। এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫৪ হাজার ১৭৯ মেট্রিক টন। এখানে চাষাবাদ হওয়া সিংহভাগ আম বিদেশি জাতের।
পার্বত্য এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কমকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত) ড. জুলফিকার আলি ফিরোজ। তিনি বলেন, পাহাড়ে আমসহ বিভিন্ন ফল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। এখন তিন পার্বত্য জেলাকে ফ্রুটজোন ঘোষণা সময়ের দাবি। ফল আবাদ, বিপণন ও পরিবহনে সরকারি ব্যবস্থাপনা জরুরি। ফল গবেষণা ইন্সটিটউট স্থাপন করা হলে এখানে আরও নতুন নতুন ফলের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাবে।