নরসিংদীর রায়পুরায় বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আফাজ উদ্দিন ও সহকারী শিক্ষক জসিম উদ্দিন (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের করা অভিযোগের তদন্ত শেষে রিপোর্ট দেওয়া নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও তদন্ত কর্মকর্তাদের উপর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এর আগে গত ২০ অক্টোবর বাঁশগাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নিকট দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুটি আলাদা আলাদা অভিযোগপত্র দাখিল করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সহকারী প্রধান শিক্ষক আফাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের করা অভিযোগপত্রে স্কুলের বিভিন্ন শ্রেনীর ছাত্রীদের গাঁ ঘেঁষে বসা, শরীরে হাত দেওয়া, ছাত্রীদের ওড়না নিয়ে বাজে মন্তব্য করা সহ অশালীন ইঙ্গিতের অভিযোগ করা হয়। এছাড়া বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় প্রেমের জালে ফেলে দীর্ঘদিনের একটি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। ২০১০ সালে মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেয়ের পরিবারের চাপে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথাও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া যৌন নিপীড়নের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করা হলেও সেটির কোনো স্থায়ী সমাধান বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন করতে পারেনি।
অন্যদিকে একই বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ক সহকারী শিক্ষক মো: জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্রে জানা গেছে, নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর তার গ্রন্থাগারে সার্টিফিকেট জাল করে এমপিওভুক্ত শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ উঠে। এতে জসিম উদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষককে দোষারুপের পাশাপাশি হুমকি প্রদান করার অভিযোগ উঠে। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরন, গাইড বই, রঙ পেন্সিল, খাতা তৈরীর নামে কাগজ বিক্রয়, শিক্ষার্থীদের ফেল করানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে কোচিং, ছাত্রীদের শরীরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে শাসন করারও অভিযোগ উঠে। এজন্য ২০১৮সালে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের বিচারে দোষী প্রমানিত হয়ে শাস্তিস্বরুপ একমাসের জন্য কর্মবিরতি ও এ স্কুলে শিক্ষক থাকা অবস্থায় ছাত্রীদের কোন ক্লাস নিতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহনের কথা অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে বিষয়টিতে সকলের চোখে ধূলো দিয়ে তিনি প্রতিনিয়তই মেয়েদের ক্লাস নিতেন জসিম মিয়া। এছাড়া সম্প্রতি এক মেয়ের সাথে তার একটি নগ্ন ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সামাজিক প্লাটফর্মে। বিষয়টি এলাকার সকল বয়সী মানুষের দৃষ্টিগোচর হলে ওই শিক্ষককে নিয়ে পুড়ো স্কুল সহ ইউনিয়নজুড়ে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এদিকে অভিযোগ দেয়ার পর এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষকের নিকট আলাদা দুটি অভিযোগ পত্রে বিদ্যালয়টির প্রায় অর্ধশতকের বেশি শিক্ষার্থী স্বাক্ষর প্রদান করে। ক্লাস ছেড়ে দুই শিক্ষকের শিক্ষকতা বাতিলে মাঠে নেমে পরে শিক্ষার্থীরা। পরে তাৎক্ষণিক বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাতুল হাসান জাকির শিক্ষার্থীদের বিষয়টিতে ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস জানিয়ে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনে। সেদিনই বিদ্যালয়ে কর্মরত ১২ জন শিক্ষক ও বাঁশগাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রাতুল হাসান জাকিরের স্বাক্ষরিত এক নোটিশে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ক সহকারী শিক্ষক জসিম উদ্দিন ও সহকারী প্রধান শিক্ষক আফাজ উদ্দিনকে সাময়িকভাবে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঘটনাটি সম্পর্কে উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসলে ঘটনার দুইদিন পর অর্থাৎ ২২ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে উপজেলা প্রশাসন। এতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সামালগীর আলমকে আহ্বায়ক ও উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ ইয়াসিন ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: জামাল উদ্দিনকে সদস্য করা হয়। তদন্তাদেশ পাওয়ার পর ৭ নভেম্বর সরেজমিনে তদন্তে যায় গঠিত ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তদন্ত কমিটি তদন্ত করে আসার প্রায় দশদিন অতিবহিত হলেও এখনও শিক্ষার্থীদের নজরে আসেনি কোনো তদন্ত প্রতিবেদন। এবার তদন্ত কমিটিকে নিয়ে বিদ্যালয়টির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সমাজের সচেতন মহলে সৃষ্টি হয়েছে নানান আলোচনার। এলাকার চা স্টল গুলোতেও চায়ের কাপে সমালোচনার ধোয়া তুলছেন স্থানীয়রা। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে কি না এমন সংশয়ও তৈরি হচ্ছে জনমনে। বিষয়টিতে দ্রুত প্রতিকার চাচ্ছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ গ্রামবাসী।
এ ব্যাপারে বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হাসান রাতুল বলেন, বিষয়টি এখন উপজেলা প্রশাসন দেখবে বলে জানিয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দাখিল করার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এখনো পর্যন্ত রিপোর্ট সর্ম্পকে আমরা কিছুই জানতে পারি নি।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির প্রধান মো: সামালগীর আলমের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্ট ইউএনও’র নিকট জমা দেওয়া হয়েছে বলে ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি।
এ ব্যাপারে রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল হাসানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের আগামী মাসিক সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হবে। অভিযোগের সত্যতা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শিক্ষার্থী ও এলাকার লোকজনের বক্তব্যে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে।