জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘতম সময়ের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তিনি সারা বিশ্বেও দীর্ঘতম সময় নিয়োজিত নারী সরকারপ্রধান। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তার ৭৭তম জন্মদিবস। এ দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
একজন প্রথিতযশা রাজনীতিক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘরে জন্ম নিলেও শেখ হাসিনার জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতী ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া নামক অজপাড়া গায়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে গ্রামের কাদামাটিতে বড় হয়েছেন। শেখ হাসিনার জন্মের সময় তার পিতা কলকাতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে থেকে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান আন্দোলন শেষ করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দমনে ব্যস্ত। রক্তে তার রাজনীতির নেশা। পরিবারের চেয়ে তাই রাজনীতির প্রাধান্য। শৈশবে শেখ হাসিনা গৃহিণী মা ও দাদা-দাদির আদর-যত্ন ও সাহচর্যে বড় হয়েছেন। বাবা অধিকাংশ সময় জেলে কাটাতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের পর যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হলে তার স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিব দুই সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ কামালসহ ঢাকায় চলে আসেন। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু বছর না যেতেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হলে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। বেগম মুজিব ভাড়া বাড়িতে উঠে অতিকষ্টে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেন। তাই বলতে গেলে শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর ছেলেমেয়েরা রাজনৈতিক পরিবেশে, দুঃখ-কষ্টের মধ্যেই বড় হতে থাকেন। মা ফজিলাতুন নেছা গৃহিণী হিসেবে ছেলেমেয়েদের লালন-পালন ও লেখাপড়ার মুখ্য দায়িত্ব পালন করলেও স্বামীর আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনীতির সহযোগী ও পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ’৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রথমে পাঞ্জাবের লায়ালপুর (বর্তমান ফয়সালাবাদ) এবং পরে মিয়ানওয়ালি কারাগারে নিয়ে গেলে বেগম মুজিবকে দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ছোট ছেলে শেখ রাসেলসহ ধানমন্ডির ১৮ নং সড়কের একটি বাড়িতে অন্তরীণ রাখা হয়। দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বামী পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ, দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে, বড় মেয়ে সন্তানসম্ভবা শেখ হাসিনা ও অন্য দুই সন্তান নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটান বেগম মুজিব। ’৭১-এর জুলাইয়ে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জন্মগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সহায়-সম্বলহীন দেশকে পুনর্গঠন করে অতিকষ্টে যখন একটি স্থিতিশীল, অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একদল উচ্চাভিলাষী ষড়যন্ত্রকারী সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে কিছু আত্মীয়-পরিজনসহ সপরিবারে হত্যা করে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ও কলঙ্কজনক ঘটনায় গোটা জাতি ও সারা বিশ্ব শোকে মুহ্যমান ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালে জার্মানির কার্লসরুহে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্টডক্টরাল রিসার্চে নিয়োজিত ছিলেন। মাত্র ১৫ দিন আগে ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা তার দুই সন্তান ও ছোট বোন শেখ রেহেনাসহ স্বামীর কর্মস্থল কার্লসরুহে বেড়াতে যান। পশ্চিম জার্মানিতে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তারা আমস্টারডাম, ব্রাসেলস ও প্যারিসে বেড়াতে বের হন। ১৫ আগস্ট বিভীষিকাময় দিনে তারা ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূত কবি সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। ঢাকায় সামরিক ক্যুর খবর পেয়ে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জার্মানির বনে ফিরিয়ে নিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাবা-মা, ভাইসহ নিকটাত্মীয়দের হারিয়ে শোকে-দুঃখে মুহ্যমান এবং আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও তৎকালে পশ্চিম জার্মানিতে নিয়োজিত ভারতের রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় তারা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে ২৪ আগস্ট ফ্রাংকফুর্ট থেকে রওনা হয়ে ২৫ আগস্ট নয়াদিল্লি পৌঁছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় ও শেখ হাসিনার স্বামী সন্তানদের সাদরে গ্রহণ করেন এবং থাকার জন্য একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেন। পরে ডক্টর ওয়াজেদ মিয়াকে দিল্লির পরমাণু কেন্দ্রে একটি চাকরি দেয়া হয়। পরিচয় গোপন করে শেখ হাসিনা দিল্লিতে অতিকষ্টে জীবন যাপন করতে থাকেন। কয়েক বছর পর শেখ রেহানা লন্ডনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে (ফুফাতো ভাই) চলে আসেন। ওখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নানা ঘাত-প্রতিঘাত, অনৈক্য ও বিভক্তির ঝুঁকি নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকে। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন এবং ঐক্য ফিরিয়ে এনে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বজনগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য একজন নেতার প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নেতারা দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার সম্মতি পেয়ে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারির কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি পদে মনোনীত করেন।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ দেশবাসী যেন বঙ্গবন্ধুকেই ফিরে পেয়েছেন। মানিক মিয়া এভিনিউর জনসমুদ্রে বক্তৃতা দেয়ার সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কেউ নাই, আমি সর্বহারা। আপনাদের মাঝে আমার হারানো পিতা-মাতা, আমার ভাই আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আমি খুঁজে পেতে চাই। আপনাদের কথা দিলাম এই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করব।’ এর পর থেকে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। দলকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি তিনি স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে যান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু জেনারেল এরশাদ ভোট ডাকাতি করে আওয়ামী লীগের অবশ্যম্ভাবী জয় ছিনিয়ে নেয়। বিরোধী দলে থেকেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অবশেষে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি সরকার গঠন করার পর সুষ্ঠু নির্বাচন ও জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনা সংগ্রাম চালিয়ে যান। সারা দেশে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে তিনি মানুষের সুখ-দুঃখ প্রত্যক্ষ করেন, অভিযোগ শোনেন এবং ‘শেখের বেটী’ হিসেবে দুঃখী মানুষের সহানুভূতি লাভে সমর্থ হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের হয়। ওই বছরই ১২ নভেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হলে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের পথ সুগম হয়। গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার সঙ্গে আলোচনাক্রমে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে এ সেতু উদ্বোধন করেন। পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ করে পদ্মা নদীর মাওয়া-জাজিরা অংশে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং তার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদকালের শেষ দিকে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতার ভূমিকায় ফিরে আসেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। এ হামলায় আইভি রহমানসহ বহু লোক প্রাণ হারান। ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে পূর্বের চেয়ে আরো পরিপক্ব, সরকারি কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষতাসম্পন্ন এবং লক্ষ্য অর্জনে অটল দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে দেখা যায়। তিনি সরকারি আমলাতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী ও নির্ভরশীল। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুআচরণ ও দক্ষতার মূল্যায়ন করেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটিকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এ প্রকল্প দ্রুত এগিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং ২০২২ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের আর্থিক সামর্থ্য তুলে ধরেন। শেখ হাসিনার এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত তাকে একজন সাহসী, আপসহীন এবং আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে ‘রূপকল্প-২০২১’ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ২০২১ সালের আগেই দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করেন। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। আগে যেখানে খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি টন, সেখানে বর্তমানে খাদ্য উৎপাদন দাঁড়িয়েছে চার কোটি টন। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক যুগ ধরে গড়ে প্রায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০২০ সালেই দেশের মাথাপিছু আয় প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭২ সালে যেখানে দেশের জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে ২০২২ সালে মোট জিডিপির আকার ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ সেখানে ২০১৯ সালে তা কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে। বর্তমানে চরম দারিদ্র্যের হার ৬ শতাংশের নিচে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরের নিচে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জীবন মানের উন্নতির ফলে ধাপে ধাপে গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ দশমিক ৪ বছরে উন্নীত হয়েছে। কেবল যে গড় আয়ু বেড়েছে তা নয়, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯৭৩-এর ২ দশমিক ৭ থেকে কমে ২০২২ সালে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৯ শতাংশ। শিক্ষার হার ২০১১ সালের ৫১ দশমিক ৭ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ১৪ বছরের কম সময়ে দেশে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো হচ্ছে। ২০২২ সালে বিদ্যুৎ সক্ষমতা বেড়ে প্রায় ২২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।
আইসিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। প্রায় ১৩ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ফলে ইন্টারনেট সেবা প্রদান সহজ হয়েছে। আইসিটি সেবা রফতানি করে বাংলাদেশ বছরে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে। দেশে নির্মীয়মাণ ও চলমান অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইসিটি পার্কে প্রচুর দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে ১০-১২টি মেগা প্রকল্প চলমান। ২০২২ সালের জুনে দেশে সর্ববৃহৎ মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। ঢাকার মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আংশিক চালু হয়েছে। কর্ণফুলী টানেল এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আরো কয়েকটি বৃহদাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং আরো কয়েকটি মেগা প্রকল্প আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে সমাপ্ত হলে দেশের অবকাঠামোগত অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও সাহস প্রশংসনীয়।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ও বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু প্রণীত পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’—এ মূলমন্ত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও অনুসরণ করেন। সেজন্য বাংলাদেশ কোনো জোটভুক্ত না হয়ে দুর্বল, সবল সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। প্রতিবেশী দেশগুলোসহ সব দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় বৈশ্বিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন, সংকট মোকাবেলায় অর্থায়ন ও সম্পদ বণ্টন, যুদ্ধ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও জ্বালানি নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে শেখ হাসিনার উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো প্রশংসিত হচ্ছে।
এ বিষয় স্বীকৃত যে বাংলাদেশের শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, রফতানির বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান, মানুষের ভোগ চাহিদা বৃদ্ধি তথা বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ গত শতাব্দীর ৮০-৯০ দশক থেকে সূচিত হয়েছিল, যার পেছনে দেশের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী, কর্মঠ জনগণ এবং সরকারের নীতি সহায়তা ব্যাপকভাবে অবদান রেখেছে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে চতুর্থ মেয়াদ পর্যন্ত অব্যাহত শাসন ক্ষমতায় থাকার ফলে দেশের শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়ন হার আগের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে। এর পেছনে কাজ করেছে শেখ হাসিনার দক্ষতা, সততা, দেশপ্রেম ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের চিন্তা ও স্বপ্ন ছিল বাংলার মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান ও তাদের কষ্ট দূর করা। শেখ হাসিনা জাতির পিতার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও শেখ হাসিনার আরো কয়েকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও কর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের অবসান এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘকালের বিরোধ নিষ্পত্তি। সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ কোস্টাল এরিয়া লাভ করায় সমুদ্রসম্পদ ও জ্বালানি প্রাপ্তির অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এসব কাজে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, সাহস এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও নিষ্ঠার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক ও গণমানুষের নেতা—মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে ক্ষমতার লড়াই করেছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও শাসন ক্ষমতায় যেতে চান মানুষের জন্য কাজ করার স্বার্থে। তার নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। দেশের মানুষের জন্য কী করা দরকার তা তার নখদর্পণে। লাভজনক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক উপকার ও জনহিতকর প্রকল্প গ্রহণ করে জনসেবা করে যাচ্ছেন। সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে বরাদ্দের মাধ্যমে দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, চা শ্রমিক, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ভাতা দিয়ে যাচ্ছেন এবং ভূমিহীন ও আশ্রয়হীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ বর্তমানে সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান এবং নানা প্রতিকূল পরিবেশেও এর অগ্রযাত্রা সারা বিশ্বে প্রশংসিত ও স্বীকৃত। সাবেক ইউনেস্কো প্রধান ইরিনা বোকোভা বলেন, ‘সাহসী নারী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছেন।’ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা।’ এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়ন করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট সরকার, স্মার্ট জনগণ, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সমাজ। বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন অগ্রযাত্রার স্বপ্নসারথি ও রূপকার শেখ হাসিনা যেন স্মার্ট বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেন, পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে সে প্রার্থনা করি।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্টদূত।
বনিকবার্তা থেকে সংগ্রহীত।