সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অসাধারণ গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার যা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি তা-ই ঘটেছে। গণআন্দোলনের তোড়ে প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে আত্মরক্ষার্থে দেশত্যাগ করেছেন। ফলে একটি পরাক্রমশালী সরকারের পতন হয়েছে। ছাত্র-জনতার ইচ্ছায় নোবেলজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ শাসন ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
এ সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো দেশের ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।
দেশের অর্থনীতি বেশ কয়েক বছর ধরেই টালমাটাল, এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতা ও অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলো দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতি আরও কঠিন চাপে পড়েছে। আবার সাম্প্রতিক নজিরবিহীন বন্যায় সারা দেশ তলিয়ে গেছে। মানুষের সহায় সম্বল নষ্ট হচ্ছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, মানুষ খাদ্য ও পানীয় জলের কষ্টে পড়েছে। এত কিছু সামাল দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নতুন সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, থিংক ট্যাংক ও সুশীল সমাজ নানা আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে এসব সমালোচনা ও পরামর্শ আমলে নেননি, বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা এবং ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভুলভাল ব্যাখ্যা করেছেন এবং একটি চিহ্নিত মহলের স্বার্থে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে একটি খবর চাউর হয়েছে যে একজন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী (পরে অর্থমন্ত্রী) পরিসংখ্যান বিভ্রাটের মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধি তথা জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, আমদানি-রপ্তানি বেশি দেখাতেন। অন্যদিকে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণেও গরমিল, পরিসংখ্যান বিভাগের মূল্যস্ফীতির হারসহ অন্যান্য তথ্যও বেঠিক বলে খবর বেরিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক সূচকগুলো আবার নতুন করে পরিমাপ করতে হবে।
একশ্রেণির ব্যাংক চেয়ারম্যান/পরিচালক ও ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কত হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন তারও সঠিক হিসাব নেই। অবাধে অর্থ পাচার হয়েছে। ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের যে পরিমাণ বেরিয়ে আসছে তা নজিরবিহীন ও বিপজ্জনক। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বেশ কজন উপদেষ্টা দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ও প্রশ্নাতীত সততার অধিকারী। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেসব নীতি পলিসি গ্রহণ করেছেন, সেগুলো সঠিক পথেই এগোচ্ছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য সিপিডির ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এ শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সার্বিক চিত্রের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে একটি দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন, যদিও এ কাজটি খুবই কঠিন। তবে পাচারকারী ও অর্থ পাচারকৃত দেশ চিহ্নিত হলে ওই সব দেশের সহযোগিতায় পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনা যেতেও পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন। নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কিছুটা কমতে পারে। তবে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির ক্রম ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে প্রয়োজন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ চেইন নিয়মিত স্থিতিশীল রাখা ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় রাখা।
দেশে তেল, চিনি, ভোজ্য তেল, গম, ডাল, আদা, পেঁয়াজ প্রভৃতি দ্রব্যাদি মূলত আমদানিনির্ভর। এসব দ্রব্যের মজুত ও সরবরাহ নিঃশেষ হয়ে আসছে। কতিপয় ব্যাংকের এলসি করার ক্ষমতা স্থগিত এবং সরবরাহকারীর প্রতিনিধি কর্তৃক এলসি গৃহীত না হওয়ায় ইতোমধ্যে সম্পাদিত এলসিগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমদানি বন্ধ বা বিঘ্নিত হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ ঘাটতি হতে পারে যা মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমন অবস্থায় ছোট-বড় আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাংকিং সমস্যা দূরীভূত করে সরবরাহ সচল রাখতে হবে। তা ছাড়া ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি উৎপাদনের কলকারখানা সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে তেল, চিনি, ভোজ্য তেল, গম, ডাল, আদা, পেঁয়াজ প্রভৃতি দ্রব্যাদি মূলত আমদানিনির্ভর। এসব দ্রব্যের মজুত ও সরবরাহ নিঃশেষ হয়ে আসছে। কতিপয় ব্যাংকের এলসি করার ক্ষমতা স্থগিত এবং সরবরাহকারীর প্রতিনিধি কর্তৃক এলসি গৃহীত না হওয়ায় ইতোমধ্যে সম্পাদিত এলসিগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমদানি বন্ধ বা বিঘ্নিত হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ ঘাটতি হতে পারে যা মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমন অবস্থায় ছোট-বড় আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাংকিং সমস্যা দূরীভূত করে বড় বড় ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের জন্য বিগত সরকারকে অর্থনীতিবিদরা নিয়মিত বলে আসছিলেন; কিন্তু কঠোর অবস্থান তো দূরের কথা, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের বহু ছাড় এবং অর্থলুট সহজ করে দিয়েছিল। প্রভাবশালী বেশ কজন ঋণখেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব ঋণখেলাপি ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন। আপাতত এসব ব্যবসায়ী আত্মগোপনে থাকলেও ব্যবসায়িক স্বার্থ ও আত্মরক্ষার্থে সরকারের কাছে তাদের ধরা দিতেই হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কতিপয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা পরিবর্তনের এবং এসব ব্যবসায়ীর সম্পত্তিতে ‘হাত’ দেওয়ার পদক্ষেপে অনেকেরই টনক নড়বে। বর্তমান গ্লোবালাইজেশন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এবং রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবের কারণে আত্মসাৎ ও পাচারকারীরা বিদেশে গিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না। এমন অবস্থায় জবাবদিহিতাবিহীন অবস্থা থেকে কঠোর অবস্থার সম্মুখীন হওয়ায় এসব ব্যবসায়ীর বোধোদয় হোক এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
এ পর্যন্ত কতিপয় দুর্বল ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অর্থ সহায়তা করে এদের তারল্য টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। নবনিযুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর অর্থ সহায়তা বন্ধ করায় এসব ব্যাংক সংকটে পড়েছে। গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। আমানতকারীরা দুশ্চিন্তায় আছেন। আশার কথা, এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও গভর্নিং বডি পরিবর্তন হওয়ায় ব্যাংকগুলো আবার সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও খেয়াল রাখতে হবে কোনো ব্যাংক যাতে দেউলিয়া হয়ে বসে না পড়ে। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে কার্যক্রম বন্ধ করলে বহু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এরূপ ঘটনা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক হবে।
বিগত সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ও পরিদর্শন, অডিট ইত্যাদি অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ব্যাংক কমিশন গঠিত হলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা, ব্যাংক পুনর্গঠন, পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা ইত্যাদি বিষয়ে সার্বিক নির্দেশনা ও পরামর্শ পাওয়া যাবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু যোগ্য, নির্লোভ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, সেহেতু অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তাদের কিছুটা সময় ও সুযোগ দিতে হবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলগুলো এ সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান।