এক মাসের বেশি সময় ধরে উত্তাল গোটা দেশ। কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে শুরুর দিকে গ্রাহ্যই করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। উল্টো প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নানাভাবে অসম্মানজনক বক্তব্য দিয়ে হেয় করেন।
একপর্যায়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দমনের নামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় সংঘাত-সহিংসতায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দুর্বৃত্তদের গুলিতে মরেছে শিশু থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী-সাধারণ জনতা।
এমন প্রাণহানি এর আগে দেখেনি দেশের মানুষ। গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। যে কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা আদালতে সুরাহা হলেও, প্রাণহানিতে জড়িতদের বিচারসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি ওঠে আন্দোলন থেকে।
এরইমধ্যে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা গত ২ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের এক দফায় পরিণত হয়। আন্দোলনের মূল প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একের পর এক কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। তাদেরকে দমন করতে করতে গিয়ে সবশেষ গত রবিবারই (৪ আগস্ট) প্রাণ ঝরেছে দেড় শতাধিক।
সোমবার সকাল থেকে রাজধানী ঢাকা ছিল থমথমে। চলছিল কারফিউ, নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটিও। বন্ধ অফিস-আদালত। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত লং মার্চ টু ঢাকা পালনে কারফিউ ভেঙে রাজধানীর পথে পথে লাখো ছাত্র-জনতার ঢল নামে।
এরইমধ্যে বেলা গড়াতেই আইএসপিআর সংবাদ দেয় বেলা দুইটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। পরে অবশ্য জানানো হয়, সংশোধিত সময় বিকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান।
দুপুর একটার পর থেকে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তারই সন্নিকটে রাজধানীর শাহবাগ মোড় দখলে চলে যায় ছাত্র-জনতার। লাখো মানুষ উল্লাসের সঙ্গে মিছিল নিয়ে সেখানে যোগ দেন। সেখানে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা বয়সী নারী-পুরুষের খেটে খাওয়া মানুষেরা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতেছে।
এমন এক সময়ে সেনাপ্রধান জাতির সামনে হাজির হচ্ছেন, যখন সারাদেশের মানুষ যখন সংঘাত-সহিংষতায় অজস্র প্রাণহানির দৃশ্য দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, মানুষের জীবন ছিল পাখির প্রাণের চেয়েও তুচ্ছ, নির্বিচারে মারা পড়ছিল যে কেউ, ক্ষোভে ফুঁসছিল গোটা দেশের মানুষ।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ নিয়ে আসছেন। এখন দেখার বিষয় তিনি জাতির এই দুর্দিনে কি আশার বাণী শোনাতে আসছেন। এরইমধ্যে তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকেও বসছেন।
মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় আগে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার সুদীর্ঘ ৩৯ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবন কমান্ডার, স্টাফ ও প্রশিক্ষকের অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক।
১৯৮৫ সালের ২০ ডিসেম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসেবে ১৩তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। সামরিক জীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন কোর্সে ভালো ফলাফলের ক্রমধারায় তিনি ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড ও স্টাফ কলেজ, মিরপুর থেকে সাফল্যের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি জয়েন্ট সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ, যুক্তরাজ্য থেকেও গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স অব ডিফেন্স স্টাডিজ (এমডিএস) সম্পন্ন করেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে মাস্টার্স অব আর্টস ইন ডিফেন্স স্টাডিজ ডিগ্রি অর্জন করেন।
জেনারেল ওয়াকার ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ৮ জুন পর্যন্ত ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহ দমনে নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন।
২০১১ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দুই বছরেরও বেশি সময় ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন তিনি। জিওসি হিসেবে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বছর নবম পদাতিক ডিভিশন কমান্ড করেন।
এরিয়া কমান্ডার, সাভার এরিয়া ও জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) নবম পদাতিক ডিভিশন হিসেবে তিনি টানা তিন বছর সফলভাবে বিজয় দিবস প্যারেড ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬-এর প্যারেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এই বিরল কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘সেনাগৌরব পদক’ (এসজিপি) এ ভূষিত হন।