দীর্ঘ ২৭ বছর যাবত এডহক কমিটি দিয়ে চলছে নরসিংদী জেলা শিল্পকলা একাডেমী। নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন না করায় দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে নরসিংদীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃত্বদানকারী এই সরকারী প্রতিষ্ঠানটি। তিন মাসের জন্য গঠন করা হয় এডহক কমিটি। এভাবে চলছে ২৭ বছর ধরে। ১৯৯৬ সালে ১ম এডহক কমিটি গঠন হয়। পরে একের পর এক এডহক কমিটি। বিশেষ করে বিগত এক যুগ ধরে শিল্পকলা একাডেমীর অবস্থা খুবই নাজুক। আজীবন সদস্যদের নাম একেবারেই ভুলে গেছে কর্তৃপক্ষ। আজীবন কিংবা বার্ষিক সদস্য নন এমন ব্যাক্তিদের এডহক কমিটিতে অর্ন্তভূক্ত করার মধ্য দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে জেলা শিল্পকলা একাডেমীকে। একাডেমীর পুরাতন অডিটরিয়াম পরিত্যাক্ত, আর নতুন অডিটরিয়ামের নাজুক অবস্থা। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে নামমাত্র, বিলভাউচার নিয়েও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা শোনা যায়।
নরসিংদী শিল্পকলা একাডেমীর রয়েছে একটি সোনালী অতীত। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সভাপতি। প্রথম সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর অক্লান্ত পরিশ্রমে নরসিংদী টাউন হলে শুরু হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। নির্বাচনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে ১৫ সদস্যের কমিটিতে ছিল নাট্যকার জালাল উদ্দিন, নাট্য ব্যক্তিত্ব আলতাফ হোসেন ভূইয়া, মোঃ ওসমান গনি, জাসাস নেতা এ বি এম আজরাফ টিপুসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ। শিল্পকলা একাডেমীতে সম্পৃক্ত ছিলেন শিক্ষক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব মোঃ ইউনুছ মিয়া, সন্তোষ শীল, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক ছিলেন সংগীতজ্ঞ প্রমোদ রঞ্জন, কেশব ঘোষ, নাজির আহমেদ, ভাস্কর ও তালযন্ত্র শিল্পী ফনি দাস, চারু ও নৃত্য ওস্তাদ মনীন্দ্র দাস, তালযন্ত্র শিল্পী ফকির পিয়ার হোসেন, সাংবাদিক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব অনুপ ভৌমিক প্রমূখ। তখন বৈশাখী মেলা, পৌষ মেলা, সাংস্কৃতিক উৎসব, লোক সংস্কৃতি মেলা, নাট্য উৎসব, যাত্রা পালা সবধরনের অনুষ্ঠানে ছিলো প্রানোর জোয়ার। এডহক কমিটির প্রথম দিকে সদস্য সচিব ছিলেন তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট সানোয়ার জাহান ভুইয়া, সালেহ আহমেদম মোযাফ্ফর, মফিদুল হক সহ আরো কয়েকজন। সে সময়েও ভাল চলছিল জেলা শিল্পকলা একাডেমী। এরপর প্রায় একযুগ পূর্বে জেলা কালচারাল অফিসার হিসেবে শাহেলা খাতুনের যোগদানের পর থেকে ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে জেলা শিল্পকলা একাডেমী। তখন থেকে ম্যাজিষ্ট্রেট এর পরিবর্তে জেলা কালচারাল অফিসার সদস্য সচিবের দায়িত্ব পান। নতুন করে গঠন করা হয় এডহক কমিটি। একদিকে নারী সদস্য সচিব, অপর দিকে প্রভাবশালী ও ব্যস্ততম ব্যাক্তিদের এডহক কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আজীবন সদস্যদের মাইনাস করা হয়। এডহক কমিটি কিংবা কোন সাব কমিটিতেও আজীবন সদস্যদের রাখা হয়নি। পর্যায়ক্রমে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের দাবী করে আজীবন সদস্যদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন জানানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে এডহক কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্যের দাপটে আজীবন সদস্যদের অস্বীকারও করা হয়। ২৪ জন আজীবন সদস্যের মধ্যে আমিনুল হক বাচ্চু, খবিরুল ইসলাম বাবুল, মোঃ জয়নুল আবেদীন, ডাঃ শফিকুল ইসলাম সরকার স্বপন, অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম লিটন, ডাঃ আতাউর রহমান, ডাঃ হাসান আল জামী, এডভোকেট জাহাঙ্গীর খন্দকার, এম আবদুস সালাম মিয়া, সাবেক এমপি আবদুল আলী মৃধা (প্রয়াত), মোঃ আলতাফ হোসেন ভুইয়া (প্রয়াত), আবদুল মতিন মিয়া (প্রয়াত), ভিপি তারেক আহমেদ (প্রয়াত), মোঃ ওসমান গনি (প্রয়াত), সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (প্রয়াত) তারা বিএনপির নেতা কিংবা সমর্থক হওয়ায় এডহক কমিটির ওই প্রভাবশালী সদস্য একাডেমীর আজীবন সদস্য তালিকার ফাইল গায়েব করে দিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পকলা একাডেমীর একজন জানিয়েছেন।
জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও নরসিংদী জেলা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এর সাবেক সভাপতি এ বি এম আজরাফ টিপু বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়। সে সময়ে আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করি। পুরাতন মিলনায়তনটির পরিচার্যা ঠিক রেখে নতুন আরেকটি নতুন অডিটরিয়ামের কাজ শুরু করি, যার অর্থায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা প্রতি মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান।
জেলা শিল্পকলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ও নরসিংদী জেলা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বলেন, আজীবন সদস্যদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একাধিকবার জেলা কালচারাল অফিসার শাহেলা খাতুন এবং এডহক কমিটির সদস্য প্রফেসর গোলাম মোস্তফা মিয়ার সাথে যোগাযোগ করলেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। আজীবন সদস্যদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দাবী জানাচ্ছি।
জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আজীবন সদস্য ডাঃ আতাউর রহমান বলেন, ১৯৯৬ সালে এডহক কমিটি গঠিত হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আওয়ামীলীগ নেতা আতাউর রহমান পিয়ার ও অহিভূষণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি প্যানেল এবং ডাঃ আতাউর রহমান ও সাংবাদিক মোঃ জয়নুল আবেদীন এর নেতৃত্বে অপর একটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচন কমিশনার ছিলেন তৎকালীন আরডিসি কাজী মেরাজ হোসেন। এডহক কমিটিতে জেলা প্রশাসক সভাপতি, ম্যাজিষ্ট্রেট সানোয়ার জাহান ভুইয়া সদস্য সচিব এবং অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তী, এডভোকেট নাসিরুল হক ভুইয়া ও রায়পুরা কলেজের লাইব্রেরীয়ান আরিফুল হুদা ছিলেন এডহক কমিটির সদস্য। নির্বাচনের নির্ধারিত দিনে ব্যালট পেপারে একজন প্রার্থীর প্রতীক না থাকায় সেদিন নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নির্বাচনের ভোটার তালিকায় কিছু অনিয়ম নিয়ে মামলা হলে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। উক্ত মামলা পরবর্তী সময়ে প্রত্যাহার হলেও অন্য জেলার একটি মামলায় সারা দেশে শিল্পকলা একাডেমীর নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। সেই মামলা শেষ হলে ২০১৪/ ২০১৫ সালের দিকে নরসিংদী সার্কিট হাউজে শিল্পকলা একাডেমী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের সাথে এক মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর তৎকালীন মহা পরিচালক লিয়াকত আলী লাকী নির্বাচনের আয়োজনের জন্য আর কোন বাধা নেই জানান। কিন্তু অদ্যাবধি নির্বাচন হয়নি।
নরসিংদীর জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী রানা রহমান বলেন, আমরা শিল্পী অথচ শিল্পকলা একাডেমীর সদস্য হতে পারছিনা। প্রফেসর মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক থাকা কালীন যে কোন সুকুমার শিল্পের শিল্পী এবং সংস্কৃতি মনা ব্যক্তি বর্গ এক হাজার টাকা ফি দিয়ে আজীবন সদস্য এবং ২৫ টাকা ফি দিয়ে বার্ষিক সদস্য হতে পারতেন, ১৫ টাকা দিয়ে নবায়ন করা যেতো। সে সময়ে দরিদ্র শিল্পীরাও একাডেমীর সদস্য হতে পারতেন। এডহক কমিটির প্রথম দিকেও আজীবন সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্ত শাহেলা খাতুন জেলা কালচারাল অফিসার পদে যোগদানের পর থেকে সদস্য হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সম্মাননা প্রাপ্ত যাত্রাশিল্পী ও সাংবাদিক টি এইচ আজাদ কালাম বলেন, করোনা পরবর্তী কালীন সময়ে যাত্রাশিল্পীদের সহায়তার জন্য ৬ টি যাত্রা পালা আয়োজনের জন্য অর্থ বরাদ্দ আসে। কিন্তু যাত্রা পালা করা হয়েছে ৫ টি। ১ টি যাত্রা পালার বাজেট ফেরত গিয়েছে নাকি আত্মসাৎ করা হয়েছে সেই প্রশ্ন রেখে তিনি আরো বলেন যাত্রা শিল্পী ও নির্দেশকদের অধিকাংশই এই বাজেট থেকে সম্মানী পায়নি। এরকম অভিযোগ অন্যান্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও রয়েছে।
নরসিংদীর সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পীরা পরবর্তী এডহক কমিটিতে আজীবন সদস্যদের মধ্য থেকে কার্যনির্বাহী সদস্য অন্তর্ভূক্ত করা এবং শিল্পী ও সংগঠকদের আজীবন ও বার্ষিক সদস্য হওয়ার সুযোগ দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবী জানিয়েছেন।