বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি সারা বিশ্বে স্বীকৃত। ১৯৭৩ সালের ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি বর্তমানে (২০২৩) ৪৬০ বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। এ দেশ একসময় ছিল বন্যা-ঘূর্ণিঝড়, অতিদারিদ্র্য ও নানা সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ক্রমাগত গড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে জিডিপি বেড়েছে। দেশের কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আমাদের মানুষের কঠোর পরিশ্রম, উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান, কৃষকের আধুনিক প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার এবং সর্বক্ষেত্রে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিসহায়তা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার দেশের শাসন ক্ষমতায় এলে এবং পরবর্তী আরো দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সরকারে ধারাবাহিকভাবে থাকার ফলে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি আরো ত্বরান্বিত হয়। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৬ শতাংশের বেশি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পত্রপত্রিকা, অর্থনীতিবিদ এবং থিংক ট্যাংক বাংলাদেশের এ অগ্রগতিকে ডেভেলপমেন্ট মিরাকল হিসেবে অভিহিত করে।
তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসারের ফলে একদিকে যেমন দেশের রফতানি আয় বেড়েছে, অন্যদিকে মহিলাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে নারীর ক্ষমতায়নে তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে। তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও বিভিন্ন খাতে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের প্রসারের ফলে জিডিপিতে শিল্পের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
কৃষিতে সরকারি ভর্তুকি এবং সার ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার ফলে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে যেখানে দেশে ১ কোটি ১০ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে, সেখানে ৫০ বছরের ব্যবধানে ধান উৎপাদন বেড়ে প্রায় চার কোটি টনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সবজি, ফল, মাছ, পোলট্রি ও গবাদি পশু উৎপাদনও বেড়েছে তিন চার-গুণ। দেশের রফতানি আয় ১৯৮০-৮১ অর্থবছরের ৭৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশের ১ কোটি ৪৯ লাখ অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ও কর্মরত রয়েছেন। বিগত বেশ ক’বছর এসব প্রবাসী বাংলাদেশী গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স আকারে পাঠিয়েছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব ও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সূচিত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা ভাব, উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে সব সমস্যা ঠিক বৈশ্বিক কারণে হয়নি, বরং অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির বেশকিছু সূচক নিম্নমুখী ও প্রতিকূল চাপের মধ্যে পড়েছে। দেশের মিডিয়া, অর্থনীতিবিদ, থিংক ট্যাংক প্রভৃতি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে নানামুখী সমালোচনা ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন।
যদিও আশু বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নেই, তথাপি সূচকের প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও সাবধানি হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি নীতিনির্ধারকদের যথাযথ ভূমিকা এবং ব্যবসায়ীসহ দেশবাসীর নির্লোভ আচরণ ও দেশপ্রেম সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সমস্যা জর্জরিত সূচকগুলো সম্পর্কে আলোচনা এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।
১. মূল্যস্ফীতি: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা মূল্যস্ফীতি বর্তমান সময়ে দেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত একটি সমস্যা। কারণ এটি সাধারণ জনগণের জীবনমানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। সরকারের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়া থামানো যাচ্ছে না। আগস্টের ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগস্টে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বর ২০২৩ মাসে কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে, যা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমান্বয়ে দ্রব্যমূল্য কমে গেলেও আমাদের দেশে এর প্রভাব দেখা যায় না। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফাখোরি প্রবণতা, কতিপয় নিত্যপণ্যের বেচাকেনা গুটিকয়েক ব্যবসায়ী কর্তৃক কুক্ষিগত করে সিন্ডিকেট গঠন, বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতার অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, টাকার অবমূল্যায়ন, বিভিন্ন মহলের চাঁদাবাজি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে দ্রব্যমূল্য কমছে না। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ যাতে পর্যাপ্ত থাকে সেজন্য প্রয়োজন বোধে এনবিআর কর্তৃক শুল্কহ্রাস, অধিক সংখ্যক ব্যবসায়ীদের আমদানির সুযোগ প্রদান এবং টিসিবি কর্তৃক আমদানি করে ন্যায্য মূল্যে বিতরণ অব্যাহত রাখতে হবে। টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন প্রভৃতি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম জোরদারের মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণ, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করে মূল্যহ্রাস করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। সব ধরনের মজুদদারি, চোরাচালানি ও কার্টেলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও সুদহার বৃদ্ধি করেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারে।
২. খেলাপি ঋণ: আর্থিক খাতের দুর্বলতা, ব্যাংকগুলোয় ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ এবং বিদেশে অর্থ পাচার বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা। দিন দিন খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, তিন মাসের ব্যবধানে জুন শেষে যা বেড়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এরই মধ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য নানা সুবিধা দিয়েছে, তা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেনি, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেক ঋণগ্রহীতা আছেন, যারা গৃহীত ঋণ ব্যবসার কাজে না লাগিয়ে নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ রিশিডিউলিংয়ের যে সহজ সুবিধা এর আগে দিয়েছে, ঋণগ্রহীতারা এর অপব্যবহার করেছেন। অনেকের মতে, এরা বরং ঋণ পরিশোধ না করার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছেন।
ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়ে আত্মসাৎ করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব খেলাপির মধ্যে চিহ্নিত ব্যবসায়ী, ব্যাংকের পরিচালক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও রয়েছেন। আবার ঋণখেলাপিরা বেনামে কিংবা ছলচাতুরী করে কিংবা অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নতুন ঋণ নিয়ে খেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি করে চলেছেন। কতিপয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ গড়ে ২০ শতাংশেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন সাবেক গভর্নর, সাবেক ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, খেলাপি ঋণের যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে মূল খেলাপি ঋণ এর চেয়ে আরো অনেক বেশি। অবলোপন, পুনঃতফসিলীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা হয়েছে। আইএমএফের হিসাব মতে, এর পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকারও অধিক। একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম তার বিভিন্ন লেখায় খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেন। ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়া বহু ঋণগ্রহীতার নামে দেশের আদালত এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকি এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের প্রতি অনুকম্পা ও পৃষ্ঠপোষকতা পরিহার এবং ব্যাংকিং আইন সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ থেকে বেরিয়ে আসার পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. বিদেশে অর্থ পাচার: অর্থ পাচার বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই কমবেশি অর্থ পাচার হয়, কিন্তু এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশের চেয়ে এত বেশি অর্থ পাচার অন্য কোনো দেশ থেকে হয় না বলে ধারণা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। জিএফআইয়ের দেয়া তথ্য মতে, আমরা যদি বিগত সময়ের সাত বছরের তথ্য পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই, প্রতি বছরই দেশ থেকে অর্থ পাচার ক্রমে বাড়ছে। যেমন ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি এবং ২০১৫ সালে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
আগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছিল যে বর্তমানে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সূত্রমতে, ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে বা আমদানি-রফতানির ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মোট পাচারের ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার অত্যধিক বেড়ে গেছে। প্রবাসী আয়ের মাত্র ৫০ শতাংশ আসে বৈধ পথে, বাকি প্রায় ৫০ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা দেশে নগদে প্রবাসীর নিকটজনকে টাকা পরিশোধ করছে আর বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে না এনে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার বহু ব্যবসায়ী তাদের রফতানি আয়ের একটা বিরাট অংশ বিদেশে রেখে দিচ্ছে। বাংলাদেশের পাচারকারীরা বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, ইউরোপের দেশগুলো, মালয়েশিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন, এনবিআর এবং পুলিশের সিআইডি মানি লন্ডারিং ও অর্থ পাচারের কেসগুলো তদন্ত করে আদালতে মামলা করে, কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অর্থ পাচারের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া, জোগসাজশ কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাচার ধরতে না পারার কারণে অর্থ পাচার কমছে না। দেশে দুর্নীতি, ঋণখেলাপি ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরকারি নিষ্ক্রিয়তা অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বর্তমানে বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে রেমিট্যান্স কম আসছে, ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর কিংবা অন্যান্য সংস্থা কার্যকর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
৪. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে, যার পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পর থেকে রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানির চেয়ে আমদানি প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার বেশি হয়, ফলে লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি পড়ে। এর পর থেকে বাজারে ডলারের চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একাধিক হারে ডলার বিক্রি শুরু হয়। বাধ্য হয়ে আমদানি সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়। টাকার মানের অবমূল্যায়ন ঘটে। তবে এখনো বৈদেশিক মুদ্রা ও টাকার বিনিময় হারের ওঠানামা বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাফেদা আমদানি-রফতানি ও রেমিট্যান্সের জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার পৃথক পৃথক মূল্যমান নির্ধারণ করে দিচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে না দেয়ায় কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের বিনিময় হারে ৭-৮ টাকা পর্যন্ত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সেজন্য হুন্ডির ব্যবহার বেড়ে গেছে এবং রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক পরিমাণ কমে গেছে। আগে প্রতি মাসে গড়ে দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পরিমাণ রেমিট্যান্স আসত। মাসিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ ক্রমাগতই কমছে। সেপ্টেম্বরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৩৪ কোটি ৩৬ ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নগতি লক্ষ করা গেছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৯১ কোটি ৬২ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ সালের একই সময়ে এসেছিল ৫৬৭ কোটি ২৮ লাখ ডলার। সে হিসাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ আগস্ট দেশের রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর ৪ অক্টোবর রিজার্ভ ২১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আইএমএফের হিসাব মতে, প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ২ বিলিয়ন। ব্যবসায়ীরা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, কাঁচামাল কিংবা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি আমদানির জন্য ব্যাংকে ডলারের স্বল্পতায় এলসি খুলতে পারছে না। এদিকে খেলাপি ঋণের আধিক্যের কারণে কতিপয় ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। আবার বহু রফতানিকারক যেমন তাদের রফতানি মূল্য সময়মতো দেশে আনছে না, অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রফতানিও হচ্ছে না। একমাত্র তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব রফতানি দ্রব্যের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। সম্প্রতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, বর্তমান হারে রেমিট্যান্স ক্ষয় হয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে পৌঁছলে অর্থনীতি ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হবে। এ অবস্থায় হুন্ডি ব্যবসা বন্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ, ডলারের নির্ধারিত মূল্য কার্ব মার্কেটের মূল্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা, অর্থ পাচার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রফতানি মূল্যের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি দেশের রফতানি বৃদ্ধির জন্য রফতানিতে বৈচিত্র্য আনয়নসহ গুণগতমানের দিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং এ ব্যাপারে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও সরকারকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
৫. ক্রমবর্ধমান হারে সরকারের ঋণ গ্রহণ: চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা পূরণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিগত বছরগুলোয় কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়ায় সরকারকে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ১ লাখ ২৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। ২০২৩-এর জুলাই শেষে ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুলাইয়ে এ ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এক বছরে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি কমছে না, বরং বাজারে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ থাকায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক বছর বিভিন্ন প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের চাহিদা ও পরিমাণও বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেয়া কঠিন শর্তে ঋণ। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় হয়। চলতি অর্থবছরের ঋণের ছাড় ১১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। স্বল্প সুদে বহুজাতিক সংস্থার ঋণপ্রাপ্তি দেশের জন্য মঙ্গলজনক। ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে (সুদ ব্যতীত) ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার সুদসহ সরকারকে ৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বিগত কয়েক বছর বেশকিছু মেগা প্রকল্পে অধিক সুদযুক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে এখন থেকে প্রতি বছর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হবে। আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ায় বৈদেশিক ঋণের সুদহারও বেড়ে গেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সময় মতো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে আসছে। এ প্রবণতা ধরে রাখতে হবে। সরকারের অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু যেভাবে দেশী-বিদেশী ঋণের চাপ বাড়ছে তাতে মেগা প্রকল্পগুলো চালু করে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ করতে না পারলে ঋণ পরিশোধ কষ্টকর হয়ে পড়বে।
অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ কমানোর লক্ষ্যে এনবিআরের কর আহরণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত সারা বিশ্বে সবচেয়ে কম (মাত্র কমবেশি ৮ শতাংশ)। রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার দীর্ঘ সময় ধরে আটকে আছে। কর জাল বাড়ানো যাচ্ছে না। দুর্নীতি এবং কর ফাঁকি লাগামহীন। সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী মহলকে এ বিষয়ে আশু দৃষ্টি দিতে হবে।
ওপরে যেসব বিষয় আলোচিত হলো যেমন—মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার টালমাটাল অবস্থা, সেগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বব্যাপী বিস্তৃত সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা হ্রাস এবং মানুষের দেশপ্রেমের ঘাটতি। একটি উদীয়মান, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ যদি মুষ্টিমেয় লুটেরা, অসৎ ব্যবসায়ী, নৈতিকতাবিবর্জিত সরকারি কর্মচারী ও রাজনীতিকের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয় তাহলে এর কুফল দেশের জনগণকেই ভোগ করতে হবে। সেজন্য সময় থাকতে সবাইকে সাবধান হতে হবে। (সংগৃহীত)
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত